চলতি বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচনেরও আগে বেশ কয়েকটি লিফট বক্তৃতা দিয়েছিলাম। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া ও তাদের সহকর্মীদের উদ্দেশে কাল্পনিক ওই”লিফট বক্তৃতা” দিয়েছিলাম। একই চেতনায়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার পরিষদকে আমি কী পরামর্শ দেব তা নিয়ে ভাবছিলাম। যদি লিফটে তাদের কয়েক মিনিট একা পাই তাহলে কিছু কথা শোনাতে চাই।
আমার মনে আছে, ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার করতে গিয়ে বেশকিছু ভুল করেছিল। এবার সে ভুলগুলো এড়ানো খুবই জরুরি বলে মনে করি। একই সঙ্গে এটাও স্বীকার করতে হবে, ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক শক্তি বেশকিছু ভুল করেছিল। প্রতিটি ইস্যু নিয়েই বিস্তৃত আলোচনা দাবি রাখে কিন্তু আমার লিফট সংলাপের লক্ষ্য হচ্ছে জরুরি কথা অল্প সময়ে বলে ফেলা। শুরুতেই আমি এটাও বলতে চাই, আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকারের সাফল্য। তারা যেন একটি সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের পথনির্দেশ করতে পারে সেই শুভকামনা নিয়ে আমার আলাপ।
২০০৭-০৮ সালের হাইব্রিড সরকারের সংস্কার এজেন্ডার মূল উপাদানগুলোর (দুর্নীতিবিরোধী অভিযান এবং রাজনৈতিক দলের সংস্কারসহ) দায়িত্ব ছিল সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের কয়েকজন ব্রিগেডিয়ারের কাঁধে। এর ফলে কুখ্যাত ‘মাইনাস টু’”নীতি তৈরি হয়েছিল, যা ব্যর্থ হয়েছিল। ফলে দলের ভেতর থেকে সংস্কারবাদী অংশটাও দুর্বল হয়ে গেল এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। অনেক আত্মবিশ্বাস নিয়ে কার্যক্রম শুরুর পরও সেনা কর্মকর্তারা ধূর্ত রাজনীতিবিদদের হাতে পরাস্ত হয়েছিলেন। আরো সহজ করে বললে, ২০০৭-০৮ হাইব্রিড তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অগ্রাধিকার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল না এবং সহজেই পথভ্রান্ত হয়েছিল। এছাড়া সরকারের বেসামরিক অংশের লোকবল কম থাকায় অনেক কাজই তারা করতে পারছিল না। এতে সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব আরো শক্তিশালী রূপ পায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও সরকারের বেসামরিক অংশকে প্রয়োজনীয় সমর্থন দিয়ে যায়নি।
ওয়ান-ইলেভেনের সরকার বার বার জোর দিয়ে বলে আসছিল, তারা ‘রাজনৈতিক সরকার’ নয়। সরকার কীভাবে কাজ করে তা নিয়ে একটি মৌলিক ভুল বোঝাবুঝির প্রতিফলন ছিল তাদের এ দাবি। যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকার দলীয় সরকার ছিল না (বাংলাদেশের ঐতিহ্য মাথায় রেখে বলতে গেলে), কিন্তু প্রকৃতগত কারণেই যেকোনো সরকারই রাজনৈতিক। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাগরিকদের সঙ্গে সংযোগের সুতো হারিয়ে ফেলেছিল যেটা রাজনীতিবিদরা করে আসতেন। রাজনীতিবিদদের বদলে ওই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে এসেছিলেন আমলা বা জুনিয়র সেনা কর্মকর্তারা।
স্বভাবগত দিক থেকে বেশ অন্তর্মুখী চরিত্রের মানুষ ড. ইউনূস। দেশের মানুষের সঙ্গে যেমন স্বতঃস্ফূর্ত নন তেমনি বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গেও সপ্রতিভ নন তিনি। ২০০৭-০৮ সরকারে পররাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল অভিজ্ঞ হাতে। কিন্তু এবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহজ যোগাযোগের সেতু না থাকায় এ সরকারকে বোঝাপড়া কিংবা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিপরীতে ওয়ান-ইলেভেনের সরকারে সেনাপ্রধানের কাছে খুব সহজে যাওয়া যেত। তিনি নিজেকে সবসময় দৃশ্যমান করে রেখেছিলেন।
যেহেতু লিফটটি এখনই তার গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে, আমি সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা এবার বলব যেন তা এ অন্তর্বর্তী সরকারের মনে গেঁথে থাকে। ২০০৭-০৮ সালের নির্বাচিত সরকারের সবচেয়ে মারাত্মক ভুল ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে তড়িঘড়ি করা। একটি নমনীয় শর্তসাপেক্ষ সময় নির্ধারণ না করে ওই সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উৎসাহে তত্ত্বাধায়ক সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ ঘোষণা করেছিল। আরেকবার এমনটি ঘটলে বলপ্রয়োগে বিশ্বাসী রাজনৈতিক শ্রেণী জানে যে তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত। তারা বুঝতে পেরেছিল যে সুবিধাগুলো সরকার থেকে অসংগঠিত রাজনৈতিক শ্রেণীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে; সুতরাং দাবি পূরণের জন্য এখন থেকে কেবল মুখের কথাই যথেষ্ট।
লিফটের দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে নতুন সরকারকে আমার শেষ মুহূর্তের পরামর্শ হবে অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকতে। শেখ হাসিনা যেমন তার শাসনের অবসান ঘটাতে পারে এমন স্ফুলিঙ্গের আভাস পাননি, তেমনি সব সরকারকেই অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। বৈশ্বিক খাদ্য ও জ্বালানির আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি ঠিকভাবে মোকাবেলা করতে পারেনি ওয়ান-ইলেভেনের সরকার। এরই মধ্যে খেলার মাঠে ছাত্রদের সঙ্গে একটি বিরোধ বৃহত্তর ক্ষোভ সঞ্চার করে এবং ছাত্র আন্দোলনের সূচনা হয়। বিশ্বব্যাপী সাম্প্রতিক ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করলে এটা দেখা যাবে যে, নিকট ভবিষ্যতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
জন ড্যানিলোভিজ
২০০৭ ও ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন
[সাউথ এশিয়া পার্সপেক্টিভস থেকে অনূদিত]