হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল টানা ১৫ বছর ৭ মাস। এ দীর্ঘ সময়ে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন, বিরোধী মত দমন, সংবিধান সংশোধন, ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক খাতে লুটপাট, তিনবারের বিতর্কিত নির্বাচন, ব্যাপক মাত্রায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, গুম, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করার ঘটনা ঘটেছে। এসব কাজে আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে কুশিলবের ভূমিকা পালন করেন সরকারের উচ্চপদস্থ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে বিধি অনুযায়ী নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকার কথা থাকলেও অভিযোগ রয়েছে, উচ্চপর্যায়ের প্রশাসনে দলীয় কর্মীর মতোই ভূমিকা রেখেছেন তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ব্যবস্থা স্বৈরতান্ত্রিক বা কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। বিশেষ করে বিরোধী দল ও মত দমনের জন্য সরকার মানবাধিকারকে ভুলণ্ঠিত করে দমন-পীড়ন ও খুন-গুমের সংস্কৃতি চালু করে। যা দেশের প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হাসিনার অঘোষিত আইনে পরিণত হয়েছিল। এসবের মাত্রা বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে সরকার টিকে থাকার হাতিয়ার হিসাবে দমন-পীড়নকেই একমাত্র অবলম্বন মনে করতে থাকে। এ কারণেই কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রুপ নেয় তখনও সরকার পুলিশ বাহিনী দিয়ে নির্বাচারে গুলি করে আন্দোলরত শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করেনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে দেখা হতো মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিককে। আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থায় ঊর্ধ্বতন পদে কাজ করেছেন তিনি। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। হাসিনার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে তিনি সামরিক বাহিনীতে রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটান ও ব্যাপক দলীয়করণ করেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে অনেক মেধাবী অফিসারের ক্যারিয়ারে প্রতিবন্ধকতা তৈরির অভিযোগ রয়েছে। অনেক গুমের নির্দেশদাতা হিসেবে বিভিন্ন সময় তার নাম আলোচিত হয়েছে। ২০১৯ সালে আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে তারিক আহমেদ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ আনা হয়। এছাড়া বহুল আলোচিত গোপন কারাগার ‘আয়নাঘর’ তৈরিতেও তারিক আহমেদ সিদ্দিক মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে দাবি একাধিক সাবেক সেনা কর্মকর্তার।
আয়নাঘরের নির্যাতনের ভুক্তভোগীদের অন্যতম লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান (বীর প্রতীক)। গত ৬ আগস্ট তিনি নিজের একাধিকবার গুম হওয়ার ঘটনা তুলে ধরেন। আর এর মূল হোতা হিসেবে দায়ী করেন মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিককে। হাসিনার পতনের পর গ্রেফতারকৃত মেজর জেনারেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) জিয়াউল আহসানও জিজ্ঞাসাবাদে আয়নাঘরের রুপকার হিসেবে তারিক আহমেদ সিদ্দিকের নাম বলেছেন।
এদিকে, স্বৈরাচারি আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তোলার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদও। ২০১৮ সালের ২৫ জুন থেকে ২০২১ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত সময়ে তিনি সেনাপ্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করেন তিনি। এছাড়া পুলিশের খাতায় অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত নিজের ভাইকে অপরাধমূলক কর্মকা-ের জন্য শাস্তি এড়িয়ে রেহাই পেতেও সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে তারা বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ রয়েছে, নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। অন্যায্যভাবে সামরিক খাতে কন্ট্রাক্ট পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য তিনি ও তার ভাইরা একযোগে কাজ করেছেন। সরকারি নিয়োগের বিনিময়ে মোটা অংকের ঘুষও নিয়েছেন।
‘ভোটিং ইন আ হাইব্রিড রেজিম: এক্সপ্লেনিং দ্য ২০১৮’ বাংলাদেশী ইলেকশন বইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো, বেসামরিক প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দল এ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে এবং তারা একে অপরের সহযোগী ছিল। বিরোধী দলের কর্মী ও প্রার্থীদের গ্রেফতার, পুলিশের উপস্থিতিতে বিরোধীদের ওপর সরকারি দলের কর্মীদের হামলা এবং প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষেত্রে দ্বৈত নীতি-এ রকম কৌশলগুলো ব্যবহৃত হয়েছে।’
স্বৈচাচারি আওয়ামী সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে বড় আয়োজন ছিল বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার। সংস্থাটির মহাপরিচালক হিসেবে ২০১১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত লে. জেনারেল (অব.) শেখ মামুন খালেদ। তার সময় থেকেই দেশে গুমের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। অভিযোগ রয়েছে, তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের গুম করে আওয়ামী লীগের ২০১৪-এর নির্বাচন জয়ে ভূমিকা রেখেছিলেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী এ সময়ে অন্তত শতাধিক ব্যক্তিকে গুম করা হয়েছিল।
২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়কালে বিশেষ ওই সংস্থার মহাপরিচালক ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) আকবর হোসেন। তার বিরুদ্ধেও বিরোধী নেতাকর্মীদের গুমের অভিযোগ রয়েছে। ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে একতরফাভাবে জয়লাভ ও বাংলাদেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য অনুযায়ী তার মেয়াদকালে অন্তত আড়াই শতাধিক ব্যক্তি গুম হয়েছেন।
২০১৭ থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওই গোয়েন্দা সংস্থার মহাপরিচালক ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আবেদীন। তিনি দায়িত্বে থাকা অবস্থায়ই ২০১৮ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ওই বছরই সবচেয়ে বেশি গুমের ঘটনা ঘটে। ওই বছর ৯৮ জনকে গুম করা হয়, যা ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল-দেড় দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়া তার মেয়াদকালে দেড় শতাধিক ব্যক্তি গুম হন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অধীন প্রতিষ্ঠান জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (এনটিএমসি) যাত্রা শুরু করে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি। ২০১৭ সালের ৬ মার্চ থেকে মেজর জেনারেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) জিয়াউল আহসান এনটিএমসির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে তিনি সরকারের হয়ে নাগরিকদের ফোনকল ও ইন্টারনেটে বিভিন্ন যোগাযোগ অ্যাপে আড়িপাতা এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থা ও ইন্টারনেট অপারেটর নিয়ন্ত্রণের কাজ করেন। এ সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে হেনস্তা, গ্রেফতার, গুম-খুনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হতো বিরোধীদলীয় মতকে। হাসিনার পতনের পর জিয়াউল আহসানকে গ্রেফতার করা হয়। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি গুম ও খুনের জন্য কথিত আয়নাঘর তৈরির জন্য হাসিনার নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের নাম উল্লেখ করেছেন।
২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত পুলিশের আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এ কে এম শহীদুল হক। এ আইজিপির সময়কালে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় ছিল সর্বোচ্চ। বিরোধী দলের ওপরেও নিপীড়ন, ধরপাকড় ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। ২০১৪ সালে জামায়াত নিধনের নামে পুলিশকে তিনি গুলি করার ক্ষমতাও দিয়েছিলেন। সে সময় সামান্য মিছিল করতে গিয়ে জামায়াতের বহু নেতা-কর্মী পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে।
বাংলাদেশ পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ তিন পদে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করেছেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। এ সাবেক আইজিপিকে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে প্রভাবশালী আইজিপি’ হিসেবে বিবেচনা করেন অনেকেই। পুরো বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেন তিনি। গত এক দশকে বিরোধী দল দমনে অতিউৎসাহী পদক্ষেপ বারবার সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। সাবেক এ আইজিপির বিরুদ্ধে বহু বিরোধী রাজনৈতিককে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে ক্রসফায়ারে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী হত্যার ঘটনা বেশি ঘটে। পুলিশের শীর্ষ পদে থাকা অবস্থায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন তিনি।
হাসিনার পতনের পর অতিরিক্ত আইজিপি ও পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান মনিরুল ইসলামকে চাকরি থেকে অপসারণ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। হাসিনা সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মনিরুল ইসলাম এর আগে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তার বিরুদ্ধেও ব্যাপক মাত্রায় মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ আছে। বিশেষ করে সিটিটিসি প্রধান থাকা অবস্থায় জঙ্গি দমনের নামে সরকারের বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের ওপরেও নির্যাতন চালানোর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার এসব কর্মকা-ের ভুক্তভোগী হয়েছে সাধারণ মানুষও। বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে এসব কর্মকা-ের কারণে বারবার আলোচনায় এসেছেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়েও পুলিশের বিশেষ গোয়েন্দা শাখার প্রধান হিসেবেও বিরুদ্ধ মত দমনে হাসিনা সরকারের অন্যতম বড় সহযোগীর ভূমিকা রেখেছেন তিনি।
মনিরুল ইসলামের মতো চাকরি থেকে অপসারিত হয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সদ্যসাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান। ২০১৮ সালের নির্বাচনে পুলিশের প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়নে হাবিবুর রহমানেরও ভূমিকা ছিল। সে সময় পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ডিআইজি (অ্যাডমিন) হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ডিএমপির তৎকালীন কমিশনার হিসেবে শিক্ষার্থীদের ওপর রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশের দমনপীড়ন ও গুলি চালানোর দায়ভারের বড় অংশে তার। হাসিনার পতনের আগের দিনও তিনি সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলনকারীদের দমাতে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দেন।
এ ছাড়াও হাসিনা সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দমন পীড়নের কুশিলব হিসাবে দলীয় কর্মীর মতো কাজ করেছেন সাবেক আইজি আব্দুল্লাহ আল মামুন, ডিবি প্রধান (ডিআইজি) হারুন, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব সরকার, প্রলয় জোয়ার্দার, বনজ কুমারসহ আরও বেশ কিছু কর্মকর্তা।
এসব প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা স্বপ্রণোদিত হয়েই সরকারের দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন। তারা নৈতিকতা বিবর্জিত হয়ে ব্যক্তিস্বার্থে এসব করেছে। সরকারের অন্যায় আদেশ তারা মানতে বাধ্য না। তারা জনগণের স্বার্থে কাজ করতে পারতেন চাইলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজেরা সুযোগ-সুবিধা নেয়ার জন্য কাজ করে গেছেন।