দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ পর্যায়ে তখন। চারদিকে ধ্বংস আর ধ্বংসাবশেষ। প্রলয়ঙ্করী এমনই এক সময়ে ইস্কান্দার মজুমদার ও তৈয়বা মজুমদার দম্পতির কোলজুড়ে নতুন ভোরের দীপ্তি নিয়ে আগমন করেন খালেদা খানম পুতুল। সময়ের পরিক্রমায় বাবা-মায়ের আদরের সেই পুতুলই বর্তমান বংলাদেশের গণতন্ত্রের সমার্থক দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ১৯৬০ সালে তৎকালীন ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সাথে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সেই থেকে দিনাজপুরের এক অরাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে খালেদা খানমের বাংলাদেশের রাজনীতি ও ইতিহাসের সঙ্গে যুগপৎ পথচলার শুরু। দিনে দিনে বাংলার আপামর জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, সুখ-দুঃখের সারথি বনেছেন। মানুষ তাকে ভালবেসে দেশনেত্রী উপাধিতে ভূষিত করেছে। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অন্যায়ের সাথে কখনো আপস করেন নি। তাই তিনি সাধারণ মানুষের কাছে আপসহীনতার প্রতীক। গণতন্ত্রের জন্য তার দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম তাকে ভূষিত করেছে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ খেতাবে। তবে তার এই দেশনেত্রী বা মাদার অব ডেমোক্রেসি হয়ে উঠার পথ কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রথম লগ্ন থেকেই বেগম খালেদা জিয়ার কণ্টকাকীর্ণ পথচলার শুরু। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালরাত্রিতে অভিভাবকহীন দিশেহারা জাতির জন্য যখন আলোকবর্তিকা হয়ে জিয়াউর রহমানের অভ্যুদয় ঘটলো তখন থেকেই বেগম জিয়ার সংগ্রামী জীবনের সূচনা। দেশমাতৃকার টানে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান ‘I Revolt’ বলে বিদ্রোহের সূচনা করেন এবং মহান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পরিবার-পরিজন রেখে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বেগম খালেদা জিয়া তার দুই শিশুপুত্র নিয়ে সেই অনিশ্চিত ও ঘোরতর অমানিশার মাঝে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। কিছুদিন চট্টগ্রামে অবস্থান করে সেখান থেকে বড় বোন খুরশিদ জাহান হকের সাথে যোগাযোগ করে দুই সন্তানসহ লঞ্চযোগে ১৬ মে ১৯৭১ নারায়ণগঞ্জে পৌঁছান। তবে তিনি বেশিদিন পালিয়ে থাকতে পারেন নি। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয়ের চেষ্টাকালে পাক বাহিনী তার সন্ধান পেয়ে যায় এবং দোসরা জুলাই এস কে আব্দুল্লাহর সিদ্ধেশ্বরীর বাসভবন থেকে তাকে গ্রেফতার করে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি সামরিক হেফাজতে বন্দিজীবন কাটান।
পাক বাহিনীর দীর্ঘ জুলুম, নির্যাতন ও অপশাসন থেকে মুক্তিলাভের পর জিয়া সামরিক শৃঙ্খলা মেনে ব্যারাকে ফিরে যান এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনী পুনর্গঠনে নিজ অবস্থান থেকে কাজ করে যেতে থাকেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ১৯৭৫ সালের ঘটনাবহুল পরিক্রমার মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জিয়া জনতার জিয়ায় পরিণত হন। ঐতিহাসিক সিপাহি জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জিয়া শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। রাষ্ট্রপতি জিয়ার শাসনকালে বেগম খালেদা জিয়া সবসময়ই পাদপ্রদীপের পেছনে ছিলেন। রাজনীতি থেকে দূরে অবস্থান করে একজন আপাদমস্তক গৃহবধূ হিসেবে অনাড়ম্বর জীবনযাপন করছিলেন। তবে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হিসেবে তিনি স্বামীর সঙ্গে বিভিন্ন দেশে সফর করেছিলেন। রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও স্বামী জিয়ার দূরদর্শীতা, বিচক্ষণতা, নেতৃত্বদানের বলিষ্ঠতা বেগম জিয়ার মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিলো। তাই তো ১৯৮১ সালের ৩০ মে কতিপয় দুষ্কৃতকারীর বুলেটের আঘাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বরণের পর তার রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ সম্পাদনের দায়িত্বভার গ্রহণ করে সফলতার সাথে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলছেন বাংলার এই অবিসংবাদিত কিংবদন্থি।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে কতিপয় বেপথু সেনাসদস্যের গুলিতে প্রেসিডেন্ট জিয়া শাহাদাতবরণ করলে তার প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি-তে আন্তঃকলহ প্রকট হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় প্রয়োজন ছিল সর্বজনে গ্রহণযোগ্য একজন নেতা, যিনি শহীদ জিয়ার দেখানো পথে তার প্রবর্তিত আদর্শকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দলকে পরিচালিত করতে পারবেন। নিভৃতচারী বেগম খালেদা জিয়াই ছিলেন সেই আইকনিক ব্যক্তিত্ব। তৎকালীন বিএনপি নেতৃবৃন্দের অনুরোধে তিনি শহীদ জিয়ার অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। সেই থেকে তার বিপ্লব ও সংগ্রামের সূচনা। ১৯৮৩ সালের মার্চে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বিচারপতি আবদুস সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব আলন করেন। অতঃপর ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি বিএনপি’র চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন এবং এখন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
১৯৮৩ সাল থেকে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি রাজপথে জনতার কাতারে নেমে এসে নেতৃত্ব দেন। তার নেতৃত্বে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনসমূহ এরশাদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণকে সাথে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। নব্বই দশকের সেই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অনেকেই সমঝে চলার নীতি গ্রহণ করলেও বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে কোন আপস করেন নি। এর ফলে বাংলাদেশের মানুষ তাকে ‘আপসহীন নেত্রী’ উপাধিতে ভূষিত করলো। একাধিকবার তিনি স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের রোষাণলে পড়েন। তাকে মোট চারবার- ১৯৮৩ সালের ২৮শে নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩রা মে এবং ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর- আটক করা হয়। ১৯৮৭ সালে হোটেল পূর্বাণী থেকে আটক করে আরো কয়েকজন নেতাসহ তাকে মতিঝিল থানায় নেয়া হয়। তবে সে সময় পুলিশ তাকে জেলে পাঠায় নি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় তাকে এক প্রকার গৃহবন্দি করে রাখা হয়। কিন্তু তিনি দমে যান নি। সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য তিনি সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বারবার দীপ্তি ছড়িয়েছেন। অতঃপর দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে ৯০ এর ছাত্রজনতার প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। জনগণের মুক্তির জন্য আপসহীন সংগ্রামী বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের রায়ে বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৯১ সালের ১৯শে মার্চ শপথ গ্রহণ করেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ তাকে শপথবাক্য পাঠ করান। এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০০১ সালের ১লা অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার নেতৃত্বে বিএনপি আরো দুইবার বিজয়লাভ করে। ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর তিনি তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন।
গণতন্ত্রের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে বেগম খালেদা জিয়ার সংগ্রাম আজোবধি অব্যহত রয়েছে। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের মতই আধিপত্যবাদি ও গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি বারবার তার উপর খড়গহস্ত হয়েছে। ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সময়েও তাকে দীর্ঘদিন কারাবরণ করতে হয়েছে। রাজনীতি থেকে তাকে মাইনাস করে দেয়ার এক নীলনকশা প্রস্তুত করেছিল এক-এগারোর অবৈধ সরকার। নানারূপ হুমকি-ধমকি, প্রলোভন দেখিয়েও তাকে দেশছাড়া করা সম্ভব হয় নি। এদেশের মানুষের সাথেই তিনি নিজের ভাগ্যকে মিলিয়ে নিয়েছেন। বর্তমানে প্রবীণ অবস্থায় এসেও অবরুদ্ধ গণতন্ত্রের মুক্তির পক্ষে কথা বলার কারণে তাকে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় কারাবন্দি থাকতে হচ্ছে। কিন্তু তিনি হার মানেননি; আধিপত্যবাদি শক্তির আগুনসদৃশ লালচোখের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি গণতন্ত্রের, জাতীয় ঐক্যের, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন। ২০১৭ সালে বকশিবাজারের বিশেষ আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘এদেশের গতি প্রকৃতির সাথে আমার নাম লেখা হয়ে গিয়েছে।’ ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবরণের আগের দিন তিনি এক বার্তায় বলেন, ‘কম বয়সে স্বামীকে হারিয়েছি। দেশেরর জন্য জিয়াউর রহমান জীবন দিয়েছেন। কারাগারে থাকতে আমি আমার মাকে হারিয়েছি। অফিসে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় একটি সন্তান হারিয়েছি। আরেকটি সন্তান দূরদেশে চিকিৎসাধীন। আমার স্বজনহীন জীবনে দেশবাসীই আমার স্বজন। আমি যেমন থাকি, যেখানেই থাকি, যতক্ষণ বেঁচে থাকবো দেশবাসীকে ছেড়ে যাবো না।’ প্রকৃত অর্থেই তিনি এ দেশের দেশপ্রেমিক আপামর জনতার আস্থা ও বিশ্বাসের মূল কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। ১৯৯১ সালে আধিপত্যবাদি শক্তির দোসরদের বিপরীতে সগর্বে মাথা উঁচু করে বেগম খালেদা জিয়া উচ্চারণ করেছিলেন, ‘ওদের হাতে গোলামীর জিঞ্জির; আমাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা।’ এই ভয়ডরহীন আত্মমর্যাদাবোধই তাকে রাজনীতির উচ্চাসনে আসীন করেছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের গেঁথে দেয়া বুনিয়াদের উপর দাঁড়িয়ে একটি সার্বভৌম মর্যাদাসম্পন্ন, প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গরার যে প্রত্যয় তার মাঝে রয়েছে, তা আর কোন রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাঝে মেলা ভার। ভুরি ভুরি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, গালগল্পের ভিড়ে বেগম জিয়ার ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’- এই একটি বাক্যই দেশ ও জনগণের প্রতি তার প্রতিশ্রুতির বর্ণনা দিতে যথেষ্ঠ। ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি এই আহবান জানিয়েছিলেন, যা আজোও বাংলাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
বিপ্লবী বেগম জিয়া বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের পাশে থাকার পুরস্কারস্বরূপ তিন তিনবার এদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। জনগণ যখনই সুযোগ পেয়েছে, তখনই তাকে নির্বাচিত করেছে। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার উচ্চাসনে আসীন হয়েও তিনি জনগণের পাশেই ছিলেন। দেশ গড়ার লক্ষ্যে, ভাগ্যবিড়ম্বিত আপামর জনতার ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে নিজেকে ব্রত রেখেছেন। স্বাধীনতার ঘোষক ও রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের সহধর্মিনি বেগম খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধে এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ-তিতিক্ষাকে অমর করে রাখা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসমূহকে সমুজ্জ্বল রাখার লক্ষ্যে প্রভূত কাজ করেছেন। তিনি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন; দুই শিশুপুত্রসহ মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে তিনি অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হয়েছিলেন। তাই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তার রয়েছে প্রবল আবেগ। তিনি ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিরক্ষা ও স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। রায়েরবাজারে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতীসৌধ নির্মাণ করে তিনি মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের হাতে নির্মমভাবে নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি জাতির সম্মান প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন। ২০০১ সালে সরকার গঠন করে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ সাধন ও তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুব্যবস্থা গ্রহণে সরাসরি সরকারকে সম্পৃক্ত করার নিমিত্তে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিযোদ্ধা রেদোয়ান আহমদ এ মন্ত্রণালয়ের প্রথম প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে খুঁজে বের করে মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রীয় পদক ‘বীর প্রতীক’ হস্তান্তর করা হয়। তিনি পাকিস্তানে অসম্মানিত অবস্থায় পড়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিক বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের দেহাববশেষ বাংলাদেশে নিয়ে আসার ব্যাবস্থা গ্রহণ করেন। ২০০৬ সালের ২৪ জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের দেহাবশেষ গ্রহণ করেন। অতঃপর তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দেশের মাটিতে সমাহিত করা হয়। এর আগে ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে খালেদা জিয়া এক জনসভায় ঘোষণা করেন, শিগগিরই মতিউরের দেহাবশেষ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হবে। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের নামে খুলনায় একটি স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছিল। যদিও পরবর্তি সরকারের আমলে এসে সেটি পরিবর্তন করে দেয়া হয়! দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষা সৈনিকদের স্মৃতি রক্ষার্থে এরকম আরো স্থাপনাসমূহের নামকরণ করেন।
তিন দফায় সরকার গঠন করে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যেগুলো এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা ও ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ এসবের মধ্যে অন্যতম। খালেদা জিয়ার সরকার রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনায় ৬০টি সংসদীয় কমিটি গঠন করেন, যাতে বিরোধীদলীয় সাংসদদেরকে গুরুত্ব সহকারে অবস্থান দেওয়া হয়।
শিক্ষাখাতে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন এবং মেয়েদের জন্য দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়াশুনার ব্যবস্থা করা তার সরকারের অন্যতম অবদান। তার সরকারের আমলেই বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা শুরু হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন তার সরকারের আমলেই গৃহীত হয়। তিনি জিয়াউর রহমানের অর্থনীতির অনুসরণ করে প্রাইভেটাইজেশনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ব্যক্তিগত আয়কর প্রদানের হার ৫৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে নিয়ে আসেন। ব্যবসায় সহজ করার লক্ষ্যে ২৭ ধরনের শুল্ক হ্রাস করে ৭ ধরণের আমদানি শুল্ক নির্ধারণ করেন। বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির সূচনা করেন। দেশের ভূ-ভাগের খনিজ সম্পদকে কাজে লাগাতে বড়পুকুরিয়ায় কয়লা খনি ও মধ্যপাড়ার শ্বেত পাথরের খনি থেকে উত্তোলন কার্যক্রমের সূচনা তার সরকারের আমলেই করা হয়। এছাড়াও ভোলা, বঙ্গোপসাগর ও দিনাজপুরে তার শাসনকালে নতুন প্রাকৃতিক গ্যাসের খনির সন্ধান পাওয়া যায়।
বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে নারীদের আত্মনির্ভরশীল রূপে গড়ে তোলার জন্য প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। আত্ম-কর্মসংস্থান কর্মসূচীর অংশ হিসেবে সহজ শর্তে ঋণসেবা সহায়তায় তিনি আনসার-ভিডিপি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাস্থ্যখাতে সমস্যা ও সংকট নিরসনে তার সরকারসমূহের কার্যক্রম সুবিদিত। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৩১ থে ৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ এবং জেলা কমপ্লেক্সকে ১০০ থেকে ২৫০ এবং ৫০ থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের জন্য তার সরকার সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশে টেলিকমিউনিকেশন খাতে তার অবদান অনস্বীকার্য। তার সময়েই সেলুলার ফোন ও আইএসডি ফোনের সূচনা হয়; অন্তত তিন লক্ষ টেলিফোন সংযোগ চালু করা হয়। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার ৩৩০টি উপজেলাকে বিদ্যুতায়নের আওতায় নিয়ে আসে। উপকুলীয় এলাকাগুলোতে এক হাজারেরও বেশি সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ করেন। ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় বেগম খালেদা জিয়ার সরকার প্রবল গুরুত্ব দেয়। তার সরকারের আমলে এদেশে অসংখ্য মসজিদ, মন্দির, ঈদগাহ ও অন্যান্য উপাসনালয় নির্মাণে সরকারি তহবিল থেকে অনুদান প্রদান করা হয়। ঢাকার আশকোনায় হজ যাত্রীদের সুবিধার্থে একটি স্থায়ী হাজি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ ছাড়াও তাবলীগ জামাতের বৃহৎ সম্মেলন বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গীতে অতিরিক্ত ৩০০ একর জমির বন্দোবস্ত করে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিতকরণ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের দৃঢ় সংগ্রাম ও রাষ্ট্র গঠনে অবিস্মরণীয় অবদান রাখা এই মহিয়সী নারীর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় যখন, তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। ১৯৮৪ সালে তখন আমরা আমার সিভিল সার্জন বাবার কর্মস্থল পিরোজপুরে ছিলাম। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে তখন তিনি বিভিন্ন জেলায় সাংগঠনিক সফর করছিলেন। এমনি এক সফরে তিনি পিরোজপুরে আসেন এবং সাবেক মন্ত্রী আফজাল সাহেবের বাসায় অবস্থান করেন। আফজাল সাহেবের বাসার ঠিক বিপরীতে ছিল আমাদের বাসা। তিনি যখন বিদায় নিচ্ছিলেন, তখন আমি তার সাদা করোলা গাড়িটির দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাকে দেখে প্রথমে তিনি বললেন, ‘এই ছেলে, সরো।’ কথার স্বর না থামতেই তিনি মায়াবি কণ্ঠে বললেন, ‘কি নাম তোমার? কোন ক্লাসে পড়ো?’ আমি কোনো ভয় না পেয়ে উত্তর দিলাম। এরপর তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সেই ছিল আমার প্রথম কথোপকথন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের এই জীবন্ত কিংবদন্তি মাদার অব ডেমোক্রেসি খ্যাত দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখন ৭৯ বছর বয়স্কা একজন নারী। কিন্তু বরাবরের মতই এই বয়সে এসেও তাকে নানারূপ জুলুম, অবিচারের শিকার হতে হচ্ছে। শাসকশ্রেণী আপসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ঔজ্জ্বল্য রুখতে অসংখ্য চেষ্টা করেছে; এখনো করছে। কিন্তু যে নামের অর্থই ঔজ্জ্বল্য, তার আবির্ভাবকে কি চিরতরে রুদ্ধ করা যায়! যায় নি। তিনি বারবার দ্যুতি ছড়িয়েছেন। যে ‘বাংলাদেশবাদ’ জিয়া এই জাতিকে দিয়ে গিয়েছেন, সেই দর্শনের ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে তিনি আগুয়ান হয়েছেন; জীবনের ঘোরতর সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় থেকেও জাতিকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। জাতিও তার উপরে আস্থা রেখেছে অদ্যাবধি। এ ধারা অব্যহত থাকবেই।
— লেখক : ড. মোর্শেদ হাসান খান, অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ও গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক, বিএনপি এবং মহাসচিব, ইউট্যাব।