আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শাসনামলে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ৬৯৯ জন। এ সময়ে গুম হন ৬৭৭ জন, কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন ১ হাজার ৪৮ জন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পরিসংখ্যানে এ তথ্য উঠে এসেছে। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের তালিকাসহ ২০২৪ সালের ঘটনা যুক্ত করলে নিহতের সংখ্যা তিন হাজার ছাড়াবে বলে দাবি সংগঠনটির।
বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়ে অধিকারের পরিসংখ্যান বলছে, আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেয়ার বছর ২০০৯ সালে হত্যার শিকার হন মোট ১৫৪ জন। এছাড়া ২০১০ সালে ১২৭ জন, ২০১১ সালে ৮৪, ২০১২ সালে ৭০ জনকে হত্যা করা হয়। নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩২৯ জনে। আর নির্বাচনের বছর ২০১৪ সালে ১৭২ জন, ২০১৫ সালে ১৮৬, ২০১৬ সালে ১৭৮, ২০১৭ সালে ১৫৫ জনকে হত্যা করা হয়।
২০১৮ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছরে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয় ৪৬৬ জনকে। ২০১৯ সালে ৩৯১ জন, ২০২০ সালে ২২৫ জনকে হত্যা করা হয়। ২০২১ সালে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারির পর তা কমে ১০৭ জন, ২০২২ সালে ৩১ ও ২০২৩ সালে ২৪ জনকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়।
এ দেড় দশকে ৬৭৭ জন গুমের শিকার হন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯৮ জন গুমের শিকার হন ২০১৮ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর। এছাড়া ২০০৯ সালে তিনজন, ২০১০ সালে ১৯, ২০১১ সালে ৩২, ২০১২ সালে ২৬, ২০১৩ সালে ৫৪, ২০১৪ সালে ৩৯, ২০১৫ সালে ৬৭, ২০১৬ সালে ৯০, ২০১৭ সালে ৮৮, ২০১৯ সালে ৩৪, ২০২০ সালে ৩১, ২০২১ সালে ২৩, ২০২২ সালে ২১ ও ২০২৩ সালে ৫২ জন গুমের শিকার হন।
শুধু অধিকার নয়, মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সলও একই তথ্য জানান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অধিকারের সঙ্গে আমাদের হয়তো সংখ্যাগত দিক থেকে কিছুটা পার্থক্য থাকবে, এটা অবশ্য খুবই ছোট। তবে অধিকারের তথ্যের ওপর আমাদের আস্থা রয়েছে।’
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সবচেয়ে বেশি হয়েছে নির্বাচনের বছরগুলোয়। অন্যান্য বছরের তুলনায় যা দ্বিগুণ ছিল। এর মধ্যে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ৪৬৬ জনকে হত্যা করা হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এ বছরই সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ গুম হয়। কারাগারে মৃত্যুও ছিল তৃতীয় সর্বোচ্চ।
গুম হওয়া ব্যক্তিদের অনেকেই এখনো নিখোঁজ। তবে ফেরত আসা ব্যক্তিদের দেয়া বর্ণনা অনুযায়ী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়ার পর নিজেদের তারা আবিষ্কার করতেন কোনো এক বদ্ধ রুমে। ‘আয়নাঘর’ কিংবা ‘সেফ হোম’ নামে পরিচিত সেই কুঠুরিতে বছরের পর বছর তাদের আটকে রেখে ভয়ংকর নিষ্ঠুর নির্যাতন করার অভিযোগ।
ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাশেম আরমানকে ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট মিরপুরের নিজ বাসা থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর থেকে নিয়মিতই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হেনস্তা করত তার পরিবারকে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আরমান পরিবারের কাছে ফিরেছেন। এতদিন তিনি আয়নাঘরে বন্দি ছিলেন বলে জানান।
আরমানের মা খোন্দকার আয়েশা খাতুনের সঙ্গে গতকাল কথা হয়। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ছেলে গুম হওয়ার পর পুরো সময়টাই আমাদের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গেছে। পুলিশি নির্যাতন, নিরাপত্তাহীনতা, বাসায় তল্লাশির মতো ঘটনা ঘটত প্রতি মাসে। এমন কোনো মাস নেই যখন পুলিশ আসত না। কখনো মিরপুর থানা, কখনো কয়েকটি থানা একসঙ্গে আবার কখনো যৌথ বাহিনীর অভিযান পরিচালিত হতো। স্থানীয় গুণ্ডাদের অত্যাচারেও আমরা অতিষ্ঠ ছিলাম। আমাদের আত্মীয়-স্বজন বাসায় আসতে পারত না, এমনকি ড্রাইভাররাও না। একপর্যায়ে আমাদের বাচ্চারা ট্রমাটাইজ হয়ে যায়। পরে ২০২১ সালে বাসা ছেড়ে দিই। কিন্তু বাসাটা ভাড়া দিতে পারলাম না।’
মীর আহমদ বিন কাশেম আরমানের ফিরে আসার বিষয়ে মা আয়েশা খাতুন বলেন, ‘আয়নাঘরে তাকে শারীরিক কোনো নির্যাতন করা হয়নি বলে জানিয়েছে। তবে তার সেলটা ছিল খুবই ছোট। সেখানে বড় ফ্যান লাগানো ছিল, সারা দিন-রাত প্রচণ্ড শব্দ করত, মাঝে মাঝে উচ্চ ভলিউমে গান বাজত। এটার প্রভাবে এখন তার মাথা সারাদিন ঝিমঝিম করে। টানা এক বছর তার চোখ বাঁধা ছিল, হাতে হ্যান্ডকাফ লাগানো থাকত। দিনের বেলা সামনের দিকে এবং রাতের বেলা পেছনের দিকে হাত বাঁধা থাকত। খাবার ও শীতের কষ্ট পেয়েছে। শীতের জন্য কাপড় দেয়নি। তবে আরমান মানসিকভাবে অনেক দৃঢ়। এখন অবশ্য তার মধ্যে সারাক্ষণ আতঙ্ক কাজ করছে, কথা বলতে সংকোচ করছে। মানুষের সামনে কথা বলতে পারে না, কেউ কথা বললে আমাদের হাত ধরে রাখে। চোখে দেখতে পারছে না, ঘুমাতে গেলে আতঙ্ক কাজ করে। সে মনে করে আমাদের সঙ্গে যে এখন থাকছে তা তার কাছে পুরোপুরি স্বপ্ন। ঘুমালেই এ স্বপ্ন দূর হয়ে যাবে!’
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) তথ্যমতে, ২০০৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশে গুমের শিকার হয়েছেন ২৫৫ জন। অন্যদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৬০ জন গুমের শিকার হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১৯২ জন এখনো নিখোঁজ। তাদের মধ্যে যেমন বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন শিক্ষার্থী কিংবা ব্যবসায়ী; যারা মূলত তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, ‘দীর্ঘদিন বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের ঘটনা অনেক বড় গুরুতর অপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ। বিরামহীনভাবে ক্রসফায়ারে হত্যা, আটক করে মুক্তিপণ দাবি, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুসহ নানা পন্থায় এসব ঘটনা ঘটানো হয়েছে। একই সঙ্গে বিচারপ্রার্থীরা যাতে বিচারালয়ে আসতে ও বিচার প্রার্থনা করতে না পারে, তার জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়া হতো, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করত।’
এসব অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ভারাক্রান্ত সাধারণ মানুষ গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছে বলে মনে করেন নূর খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এখন সময় এসেছে গুম ও ক্রসফায়ারের শিকার মানুষদের বিচার এনে দেয়ার। এর জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে, যে কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা থাকবে। এসব ঘটনায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যারাই জড়িত ছিল তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কোনো সরকার বা কোনো বাহিনীর লোক এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সাহস না পায়। আর যারা মিসিং, তাদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিতে হবে, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।’
দেশে বিগত ১৫ বছর ধরে যে সরকার ছিল তারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেনি বলে মন্তব্য করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রকে তারা মেরে ফেলেছে, মানুষের আইনি অধিকার কেড়ে নিয়েছে, সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করেছে। রাজনৈতিকভাবে যারা সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করেছে তাদের গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আজকে আয়নাঘরের কথা প্রকাশ্যে আসছে, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম-খুন, নিখোঁজের শিকার সব ঘটনা প্রকাশিত হবে। ইনটেরিম গভর্নমেন্টের কাজ হচ্ছে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার অনুসন্ধান এবং এর শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠবে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, প্রমাণিত হলে তার জন্য বিচার নিশ্চিত করতে হবে। যারা অকারণে বিচারবহির্ভূতভাবে নিহত হয়েছেন।’