আশির দশক। ভয়ানক অর্থনৈতিক সংকটে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফিলিপাইন। তবে তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই দেশটির প্রেসিডেন্ট মার্কোসের। অর্থনীতি ঠিক করার চেয়ে বিপুল অর্থ ব্যয়ে চিত্রকর্ম সংগ্রহেই মনোযোগ বেশি তার। জুতা, গাউন ও গহনা সংগ্রহে লাখ লাখ পেসো ব্যয় করছেন ফার্স্ট লেডি ইমেলদা মার্কোস। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই। বিরুদ্ধ মত দমন হচ্ছে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে। সরকারি বাহিনী ও মার্কোস অনুগতদের হাতে খুন হয়েছে প্রায় ৩ হাজার মানুষ। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এরই মধ্যে নিষ্ঠুরতম স্বৈরশাসকের তকমা পেয়ে গেছেন মার্কোস। একপর্যায়ে তার বিরুদ্ধে মাঠে নামে ক্ষুব্ধ ফিলিপিনোরা। আন্দোলন রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানে। ১৯৮৬ সালের সে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে দেশ থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপে আশ্রয় নেন মার্কোস। তিন বছরের মাথায় নির্বাসনেই মৃত্যু ঘটে ক্ষমতার শোকে বিপর্যস্ত মার্কোসের।
গত কয়েক দশকে এমন গণ-অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন অনেক স্বৈরশাসক। কিন্তু দেশত্যাগ করে পালানোর পর তাদের বেশির ভাগই দেশে ফিরতে পারেননি। আমৃত্যু নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। আর হাতেগোনা যে কয়জন দেশে ফিরতে পেরেছেন, তাদের কেউই রাজনীতিতে নিজেকে পুনর্বাসন করতে পারেননি আর।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো আলী রীয়াজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স্বৈরাচারী শাসকরা যখন গণরোষের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয় তখন তাদের অধিকাংশই দেশত্যাগে বাধ্য হয়। অতীতে যেসব দেশ তাদের সমর্থন করেছে, সাহায্য করেছে তারা তাদের কাছে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা সে আশ্রয় লাভে সক্ষম হয় না, কারণ এসব দেশের কাছে তাদের আর কোনো গুরুত্বও থাকে না। তাদের কেন্দ্র করে এসব সরকারের ভবিষ্যৎ কোনো পরিকল্পনা থাকে না। এছাড়া স্বদেশের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের কারণেও এ ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারীরা আর নিজেদের পুনর্বাসিত করতে পারে না। ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী শাসকদের জীবন শেষ হয় নিঃসঙ্গভাবে। তাদের অধিকাংশ কেবল ইতিহাসের আস্তাকুঁড়েই নিক্ষিপ্ত হয় না, তারা আক্ষরিক অর্থেই আস্তাকুঁড়ের জীবনযাপন করতে বাধ্য হন।’
কোনো কোনো স্বৈরশাসক নিজ দেশে ফিরতে পেরেছিলেন ঠিকই। তবে তাদের কেউই রাজনীতিতে আর সেভাবে ফিরতে পারেননি। এমনই এক স্বৈরশাসক বলিভিয়ার ইভো মোরালেস।
দেশটির প্রথম ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থেকে উঠে আসা প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। সে জায়গা থেকে শুরুতে জননন্দিতও হয়েছিলেন। তার কিছু সংস্কার বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল। কিন্তু যেনতেন উপায়ে ক্ষমতা ধরে রাখার প্রয়াস তাকে একপর্যায়ে জনগণের সামনে উপস্থাপন করে স্বৈরশাসক হিসেবে। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পর ২০১৯ সালে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে বিক্ষোভ শুরু হয়। গণরোষের মুখে পদত্যাগ করে মেক্সিকো পালিয়ে যান তিনি। পরে দেশে ফিরলেও রাজনীতিতে আর সুবিধা করে উঠতে পারেননি তিনি।
স্বদেশে ফিরতে পারলেও জীবনের বাকি সময় কারাগারেই পার করতে হয়েছে চিলির স্বৈরশাসক অগাস্তো পিনোশেকে। ক্ষমতা হারানোর পর লন্ডনে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ১৯৯৮ সালের ১০ অক্টোবর স্প্যানিশ একটি আদালতের পরোয়ানার ভিত্তিতে লন্ডন পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। আইনি লড়াই চালিয়ে গেলেও শেষ রক্ষা হয়নি তার। তাকে নিজ দেশে ফেরত পাঠায় ব্রিটিশ সরকার। দেশে ফেরার পর তার বিরুদ্ধে হত্যা, গুম, নির্যাতনের সুনির্দিষ্ট ঘটনায় দায়ের করা হয় মামলা। সেই মামলায় দায় নিয়েই ৯১ বছর বয়সে পিনোশে যখন মারা যান তখনো তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে ৩০০ ফৌজদারি অপরাধের মামলা চলছিল।
শ্রীলংকা নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে ২০২২ সালের এপ্রিলে। দেশটির প্রেসিডেন্ট তখন গোতাবায়া রাজাপাকসে। আর প্রধানমন্ত্রী তার ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে। শ্রীলংকার অর্থনীতির মারাত্মক পরিণতির জন্য দায়ী করা হয় রাজাপাকসে পরিবারকেই। দেশটির মোট অর্থনীতির প্রায় তিন-চতুর্থাংশ তাদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। আবার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানা অপরাধেরও অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে।
শ্রীলংকা দেউলিয়া হয়ে পড়ার কিছুদিনের মধ্যেই জনরোষের মুখে পড়ে রাজাপাকসে পরিবার। মে মাসে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে সেনাবাহিনীর কাছে আশ্রয় নেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। জুলাইয়ে গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশত্যাগ করে প্রথমে মালদ্বীপে, পরে সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান। সেখানে তাকে ১৪ দিনের ‘ভিজিট পাস’ দেয়া হয়। এখানে অবস্থানকালেই ১৪ জুলাই নিজের পদত্যাগপত্র দেশে পাঠান গোতাবায়া। ১৫ জুলাই তার আনুষ্ঠানিক পদত্যাগের ঘোষণা দেন শ্রীলংকার সংসদ স্পিকার। পরে থাইল্যান্ডে পাড়ি জমান তিনি। এর প্রায় দেড় মাস পর ‘বিশেষ নিরাপত্তা’ নিয়ে তিনি ফেরত আসেন নিজ দেশে। যদিও এখনো রাজনীতিতে ফিরতে পারেননি গোতাবায়া রাজাপাকসে।
তিউনিসিয়ার স্বৈরশাসক জাইন এল-আবিদিন বেন আলির বিরুদ্ধে ২০১১ সালে ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়, যা জেসমিন বিপ্লব নামে পরিচিত। এটি একসময় জন্ম দেয় আরব বসন্তের। সে বিপ্লবের একপর্যায়ে বেন আলির ২৩ বছরের মসনদ হাতছাড়া হয়। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে সপরিবারে সৌদি আরবে পালিয়ে যান বেন আলি। এরপর আর দেশে ফিরতে পারেননি তিনি। সৌদি আরবে নির্বাসিত জীবনযাপন করেন। ৮৩ বছর বয়সে সেখানেই মৃত্যু হয় তার।
স্বৈরশাসকদের নির্বাসিত জীবন প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোর উৎস যদি আগের জায়গায় থেকে যায়, যেমন প্রধানমন্ত্রী বা কয়েকজনকে সরিয়ে ক্ষমতা কাঠামোর সামান্য পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়, যদি পুরনো ক্ষমতা কাঠামো থেকে যায়, তাহলে একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে। আর যদি আগের ক্ষমতা কাঠামো দুই-তিন স্তরে ভেঙে যায়, তাহলে পুরনোদের ফিরে আসার আর সুযোগ থাকে না। এজন্য স্বৈরশাসকদের প্রত্যাবর্তন ঠেকাতে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও ক্ষমতার উৎস গণ-অভ্যুত্থানকারীদের দ্বারা পরিবর্তন করতে হয়।’
আফগানিস্তানের ২০১৪ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ করেন আশরাফ গানি। তবে ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মার্কিন সৈন্যদের শেষ দলটি আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এর সঙ্গে সঙ্গেই একের পর এক শহর দখলের অভিযান শুরু করে দেয় তালেবানরা। এরই ধারাবাহিকতায় কাবুলেও অভিযান চালায়। তালেবানদের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছাকাছি চলে আসার খবর পেয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয় আশরাফ গানিকে।
কিন্তু দেশ পালানো শাসকদের মধ্যে তার অবস্থাটি ছিল ভিন্ন। তিনি খালি হাতে দেশত্যাগ করেননি। বরং চারটি গাড়ি ও হেলিকপ্টারে ভরে নগদ অর্থ নিয়ে ওমান হয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পালিয়ে যান। ২০২১ সাল থেকে সেখানেই মানবিক আশ্রয়ে আছেন এ নেতা। নিজ দেশ ও রাজনীতি কোনোটিতেই ফেরা হয়নি আফগান এ নেতার।
এ প্রসঙ্গে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান (বীর বিক্রম) বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স্বৈরশাসকরা দেশে ফেরত আসতে না পারার কারণ হলো, দেশে যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তাদের অনুকূলে থাকে না। ফিলিপাইনের মার্কোস চলে যাওয়ার পর তার বিরোধী সরকার ক্ষমতায় আসে। বিরোধী সরকার কখনো চাইবে না যে সে এসে ক্ষমতায় বসুক। আর যদি অনুকূলে হয়ও, ক্ষমতা এমন একটি জিনিস, নিজের মানুষও ক্ষমতা পরিবর্তন করতে চায় না। আওয়ামী লীগের যেসব নেতা ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বিদেশ চলে গিয়েছিল, তারা কেউ ফিরে আসেনি। কারণ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও নেতারা একজন আরেকজনের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে চাইবেন না। এজন্য বিদেশে একবার চলে গেলে ফেভারেবল সরকার থাকলেও দেশে আসা সম্ভব হয় না, আনফেভারেবল সরকার থাকলে তো আরো সম্ভব নয়। আর জনগণ আসলে চায় না বলেই তারা ফেরত আসতে পারেন না। ফেরত আসলেও জনগণ চায় না বলে রাজনীতিতে তাদের পুনর্বাসন ঘটে না।’
গণ-অভ্যুত্থানের মুখে দেশত্যাগকারীদের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন বাংলাদেশের শেখ হাসিনা। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া গণ-অভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালান তিনি। গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশ ছাড়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা। বর্তমানে ভারতে ‘নিরাপদ আশ্রয়ে’ আছেন তিনি। তার যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রার্থনা এরই মধ্যে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো দাবি করছে। ভিসা বাতিল করেছে যুক্তরাষ্ট্রও। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় তার মা আর রাজনীতি করবেন না বলে শুরুতে ঘোষণা দেন। যদিও পরে এক সাক্ষাৎকারে নীরবতা ভেঙে রাজনীতিতে ফেরার ইচ্ছের কথা জানিয়েছেন শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজীম উদ্দিন খান বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনায় ফেরার চান্স থাকে, যদি পার্টি হিসেবে তারা খুবই শক্তিশালী হয়। শক্তিশালী না হলে ফেরার খুব বেশি সুযোগ থাকে না। আওয়ামী লীগ এখন সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী নয়। তাদের পুরো শক্তি একজনের মধ্যে। এ সাংগঠনিক শক্তি শুধু বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে। কিন্তু শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারবে না। যে পরিমাণ হত্যাযজ্ঞ তারা চালিয়েছে এর মাধ্যমে তারা কয়েক প্রজন্মের সমর্থন হারিয়েছে। দেশে ফেরা তাদের জন্য খুব একটা সহজ হবে না। আন্দোলন দমন করতে আওয়ামী লীগ যে উপায়ে হত্যা করেছে, তা খুবই নজিরবিহীন। তাদের দল এখন মানুষের কাছে বিভীষিকায় পরিণত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিকভাবে গণহত্যার বিচারের জন্য আইসিসির (আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্ট) মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার বিচার শুরু হলে উনার পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। এটাকে পরে যদি সাধারণ হত্যাকাণ্ড হিসেবেও দেখা হয় তবুও উনার পরিস্থিতি খুব একটা ভালো হওয়ার কথা না।’