এক-এগারো পরিস্থিতির মতোই ফের মাইনাস টু ফর্মুলায় মেতে উঠেছে দেশের একটি শীর্ষ দৈনিক পত্রিকা। ২০০৭ সালে রাজনীতি থেকে দুই নেত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে সরানোর নীলনকশা এঁকেছিল পত্রিকাটি। দীর্ঘ দেড় যুগ পরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ফর্মুলা অভিন্ন হলেও মাইনাসের তালিকায় খালেদার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এক-এগারো ও এর পরবর্তী সময়ে তারেক রহমানকে রাজনীতিতে ‘ভিলেন’ বানানোর অপ্রতিরোধ্য অপচেষ্টার অংশ হিসেবে অব্যাহতভাবে তার চরিত্র হনন করা হয়েছিল।
তাকে জঙ্গি সম্পৃক্ততা, সন্ত্রাসের গডফাদার, দুর্নীতিবাজ ও বিত্ত-বৈভবের মালিক দেখিয়ে মানুষের কাছে খাটো করার পাশাপাশি তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দেওয়ার মিশনও নেওয়া হয়েছিল। পর্দার অন্তরালে ওই দৈনিকটির এ ধরনের নীরব নীলনকশা এখনো চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে এরই মধ্যে রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। বিএনপি নেতাদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে তীব্র অসন্তোষ।
শহীদ সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক কারণে দেশান্তরি। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নস্যাৎ করতে চরিত্র হনন থেকে শুরু করে তাকে সন্ত্রাস-দুর্নীতির ‘বরপুত্র’ বানিয়ে ছেড়েছিল কারওয়ান বাজারের একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকা। ইসলামবিদ্বেষী ও ধর্মভীরু মানুষকে জঙ্গি বানানোর দায়ে অভিযুক্ত পত্রিকাটির অফিসের সামনে অতি সম্প্রতি ইসলামপন্থী একটি ক্ষুব্ধ পক্ষ প্রতিবাদ করে গরুও জবাই দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, হীন উদ্দেশ্যে সমাজে ভুল বার্তা দিয়ে জনরোষ তৈরি করতে তারেককে জড়িয়ে শত শত প্রতিবেদন ছাপিয়ে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ‘বরবাদ’ করার সব অপচেষ্টাই করেছিল ভারতের র-এর এজেন্ট বলে সমালোচিত এই জাতীয় দৈনিকটি।
এক-এগারো বাস্তবায়নে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া পত্রিকাটির মূল এজেন্ডাই ছিল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাশাপাশি তারেক রহমানকেও ‘মাইনাস’ করা। পত্রিকাটিতে প্রকাশিত অসংখ্য কার্টুন, সংবাদ ও কলাম বিশ্লেষণ করে এমন চিত্রই ধরা পড়ে। পত্রিকাটির হাতে তৈরি অনেকেই এখন সরকারের অংশ। সমালোচকরা বলছেন, স্বৈরাচারের পতন হলেও কিংবা তারেক রহমান অনেক মামলায় খালাস পেলেও কিছু মামলা এখনো জারি রয়েছে। এখনো তারেক রহমানের দেশে ফেরার পুরো আস্থা না পাওয়ার মূলেও ওইসব বিষয় রয়েছে।
আর এটি যেন বিলম্বিত হয়, ভেতর থেকে পত্রিকাটি সেই চেষ্টাই করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। সময়-সুযোগ বুঝে তাই আগের নীলনকশা বাস্তবায়নে পত্রিকাটি সক্রিয় রয়েছে বলে জানা গেছে। এসব নিয়ে বিএনপি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে শোরগোল ও আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।
পত্রিকাটি প্রথম আলো। অভিযোগ রয়েছে, দেশের বড় দুই দলকে বাদ দিয়ে রাজনীতিতে ‘তৃতীয় ধারা’ তৈরির প্রবক্তা প্রথম আলো এক-এগারোর সময় ব্যর্থ হলেও এখনো তাদের ‘মাইনাস টু প্লাস ফর্মুলা’ থেমে নেই। শুধু তারেক রহমানই নয়, চরিত্র হনন করে অসংখ্য প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছিল তারেক রহমানের ছোট ভাই ও জিয়াপুত্র আরাফাত রহমান কোকোর নামেও। আর্কাইভ ঘেঁটে দৈনিক প্রথম আলোর প্রকাশিত শত শত সংবাদ শিরোনাম চোখে পড়ে, যেখানে মূলত বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমান ও প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর চরিত্রই হনন করা হয়েছিল।
বিএনপিকে জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতার সঙ্গে জড়িয়ে পত্রিকাটি একের পর এক প্রতিবেদন ছেপেছিল। এর সম্পাদক মতিউর রহমানের নেতৃত্বে প্রকাশিত এসব প্রতিবেদন এখন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সবই ছিল অসার। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় বিএনপি ও তারেক রহমানকে জড়িয়ে অনেক প্রতিবেদন ছাপে পত্রিকাটি। অতি সম্প্রতি ওই মামলায় তারেক রহমানসহ সব আসামি খালাস পান। মামলার রায়ে খালাসের পর তারেক রহমানকে জড়িয়ে পত্রিকাটিতে ছাপা হওয়া ওইসব প্রতিবেদন এখন সামনে এসেছে। বিএনপির কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে এখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে—প্রথম আলো ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় তাকে জড়িয়ে যেভাবে চরিত্র হনন ও হেয় প্রতিপন্ন করেছিল, তার দায় কে নেবে? এই মানহানির দায় কিভাবে মেটাবে পত্রিকাটি?
২০০৭ সালের ৭ জুন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান নিজে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লেখেন ওই পত্রিকায়। এর শিরোনাম ছিল ‘তারেকের দুর্নীতির বিচার হতে হবে’। তারেক রহমান কার কার সঙ্গে মিলে, কিভাবে দুর্নীতি করেছেন আর এ জন্য তিনি হলফনামায় কিভাবে ক্ষমা চেয়েছিলেন—এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে লেখা ওই মন্তব্য প্রতিবেদনে মূলত তারেক রহমানকে জনসাধারণের কাছে হেয় করার সব উপাদানই যুক্ত করেছিলেন। মতিউর রহমান ওই মন্তব্য প্রতিবেদনে লেখেন, ‘মামুনের (গিয়াসউদ্দিন আল মামুন) সব অবৈধ কর্মকাণ্ড এবং বড় বড় দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির কথা তারেক রহমান জানতেন এবং ভাগ পেতেন।’
মতিউর রহমান তারেক রহমানকে দুর্নীতিবাজ প্রমাণ করতে প্রতিবেদনের এক জায়গায় লেখেন, ‘আসলে বিগত পাঁচ বছরে তারেক ও মামুন যৌথভাবে যে অর্থবিত্ত আর সম্পদের বিপুল পাহাড় গড়ে তুলেছেন এবং সে সম্পর্কে দেশব্যাপী যে ব্যাপক জনশ্রুতি ছিল, মামুন-বাবর ও অন্যদের বক্তব্য-বিবৃতিতে সে সবই পুরোপুরি প্রমাণিত হয়েছে। পাশাপাশি এটিও বিশ্বাস করার অনেক কারণ আছে যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জ্ঞাতসারেই তারেক-মামুন চক্র এসব অপকর্ম করেছে।’
ওই মন্তব্য প্রতিবেদনের আরেক জায়গায় মতিউর রহমান লেখেন, ‘তারেক তার কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে দেশের যে ক্ষতি করেছেন, তাতে কোনো সরকারই তাকে ক্ষমা করতে পারে না। এটা সম্ভব নয়।’
পত্রিকাটিতে প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘তারেক, বাবর, হারিছ ও মামুন বিএনপির চার মহাদুর্নীতিবাজ’। আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম, ‘তারেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা, স্ত্রী-শাশুড়িও আসামি’। তারেক রহমানকে ফাঁসানোর পরিস্থিতি উসকে দিতে সম্পাদক মতিউর রহমান ২০০৮ সালের ২৬ জানুয়ারি আরেকটি মন্তব্য প্রতিবেদন লেখেন। “২১ আগস্ট হামলা : সত্য বেরিয়ে আসছে, ‘আষাঢ়ে গল্পকারদের’ কী হবে” এই শিরোনামে। ওই মন্তব্য প্রতিবেদনের সঙ্গে একটি তিরস্কারমূলক কার্টুনও জুড়ে দেওয়া হয়েছিল।
তারেক রহমানের চেহারা বিকৃত করে কার্টুন বানিয়ে আরেকটি সংবাদ প্রতিবেদন ছাপা হয় ২০০৮ সালের ২৫ মার্চ। শিরোনাম, ‘দুর্নীতির মামলা তারেকের বিরুদ্ধে, অভিযোগপত্র দেওয়া হচ্ছে শিগগির’। তারেকের চরিত্র হনন হয় এমন উপাদানে আরেকটি সংবাদ করে প্রথম আলো। শিরোনাম, ‘তারেকের বিরুদ্ধে পাঁচ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ’।
২০০৮ সালের ২৪ এপ্রিল দৈনিকটি তারেককে জড়িয়ে আরেকটি প্রতিবেদন করে। এতে তারেক রহমানের সঙ্গে কোকো ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরের ছবিও ছাপা হয়। শিরোনাম ছিল, ‘বাবরের ২১ কোটি টাকার ঘুষের মামলার অভিযোগপত্রে তারেক আসামি’। এতিমখানার টাকা আত্মসাতের সঙ্গেও জড়ানো হয় প্রথম আলোর সংবাদে। এসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ছাপে পত্রিকাটি। শিরোনাম ছিল, ‘এতিমখানার টাকা আত্মসাৎ : তারেকের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে’।
২০১৪ সালের ১২ জুন সোহরাব হাসানের নামে একটি কলাম ছাপে প্রথম আলো। ওই কলামের শিরোনাম ছিল, ‘তারেক বিএনপির ভরসা, না বোঝা?’ মূলত তারেক রহমানকে ব্যর্থ প্রমাণ করতেই কলামটিতে তার সম্পর্কে মনগড়া সব বিশ্লেষণ করা হয়। তারেক রহমানকে ভিলেন বানানোর লক্ষ্যে লেখা এই কলাম লেখকের আরেকটি কলামের শিরোনাম ছিল, ‘আবার তারেক যুগ! আবার হারিছ প্রশাসন!’
২০১২ সালের ১৯ মার্চ পত্রিকাটি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় তারেককে জড়িয়ে আরো একটি প্রতিবেদন ছাপে। শিরোনাম, ‘বিচার শুরু, বাবর তারেক মুজাহিদসহ আসামি ৫২’। পত্রিকাটি গ্রেনেড হামলার পেছনে তারেকের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণে তৎপর ছিল। তাই একের পর এক প্রতিবেদন ছেপেছিল। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সম্প্রতি ওই মামলায় তারেকসহ সব আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
জঙ্গিবাদের সঙ্গে তারেক রহমানের নাম জড়িয়ে অনেক সংবাদ প্রকাশ করে পত্রিকাটি। উইকিলিকসের বরাতে নিজেদের মতো করে মনগড়া এ রকম একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম, ‘বাংলা ভাইয়ের সহযোগীর মুক্তির ব্যবস্থা করেন তারেক রহমান’।
পত্রিকাটি তারেক রহমানকে খাটো করতে হেন বিষয় নেই, যা লেখেনি। একবার টেলিফোনে নাগরিক মন্তব্য নাম দিয়ে একটি বিশেষ আয়োজন করে। এতে সাধারণ পাঠককে ‘তারেক রহমানের রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা : আপনার মন্তব্য কী?’—এ রকম প্রশ্ন করে রাজনীতি থেকে তার সরে যাওয়ার বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়ে জনমত তৈরির চেষ্টা করা হয়। ওই আয়োজনে শিরোনাম করা হয়, ‘রাজনীতি থেকে তারেক রহমানের অবসরের ঘোষণাকে স্বাগত জানাই’। এতে যেসব পাঠক তারেকের সরে যাওয়ার পক্ষে বলেছেন, তাদের মন্তব্যই জুড়ে দেওয়া হয়।
প্রথম আলো শুধু যে তারেক রহমানকে নিয়ে লিখেছে তা-ই নয়; প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোকে নিয়েও পত্রিকাটিতে অনেক প্রতিবেদন ও কলাম ছাপানো হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘খোলা চোখে’ শিরোনামে পত্রিকাটিতে কলাম লেখেন বিশেষ প্রতিনিধি হাসান ফেরদৌস। কলামের নাম দেন ‘কোকো কাহিনি’। এতে মূলত কোকোর চরিত্র হনন করা হয়।
ওই পত্রিকায় কোকোকে নিয়ে একটি সংবাদের শিরোনাম, ‘কোকোর ৬ বছরের জেল’। আরেকটি শিরোনাম, ‘কোকোর বিচার শুরু’। ওই প্রতিবেদনে কোকোর একটি কার্টুন আঁকা হয়। এতে কোকোর মাথাকে একটি মানিব্যাগের আদলে এঁকে সেই ব্যাগের চেইন খোলা রাখা হয় এবং ওই খোলা জায়গা দিয়ে টাকা-পয়সা বের হয়ে আসার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়। এর মাধ্যমে কোকোকে দুর্নীতিবাজ ও টাকা পাচারকারী হিসেবে দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজনীতিসচেতন সাধারণ মানুষ ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, পত্রিকাটির এ রকম অসংখ্য সংবাদ প্রতিবেদন, কার্টুন ও কলামের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, তা হলো মানুষের কাছে তারেক রহমানকে রাজনীতিতে ‘ভিলেন’ বানিয়ে তাকে ‘জিরো’ করে দেওয়া। এমন একটি খারাপ ভাবমূর্তি তৈরি করা, যাতে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ‘বরবাদ’ হয়ে যায়। এমনকি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে পরিস্থিতি অনুকূলে পেয়ে তারেক রহমানকে রাজনীতি থেকেই ‘মাইনাস’ করে দেওয়ার মহানীলনকশায় মেতে উঠেছে একের পর এক ইসলামপন্থী ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার ঘটনায় বিতর্কিত পত্রিকাটি। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় হওয়া উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মামলায় জামিন হলেও তার দেশে ফেরার পথ কণ্টকাকীর্ণ করতে বহুমুখী ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে মতিউর রহমানের নেতৃত্বাধীন পত্রিকা প্রথম আলো।