গণঅভ্যুত্থানে ছেলেকে সাহস জোগানোর ভিডিও ভাইরাল, যা ঘটেছিল সেদিন

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এমবিএ গ্র্যাজুয়েট সানিয়াতকে ডিবি পুলিশ আটক করে। ২৪ জুলাই অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত পুলিশের হেফাজতেই বন্দি ছিলেন তিনি। 

রোববার (২৮ জুলাই) রাতে সবেমাত্র তাহাজ্জুদ নামাজ শেষ করেন শামীমা বারকাত লাকি। বড় ছেলে ওমর শরীফ মোহাম্মদ ইমরান, যাকে সবাই সানিয়াত নামে চিনে সে তখনও পুলিশের হেফাজতে। মায়ের মন। ছেলের চিন্তায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আচমকা ফোন বাজলো। চার অঙ্কের ফোন নাম্বারের কল রিসিভ করতেই ছেলের যন্ত্রণাক্লিষ্ট ও কান্নাভেজা কণ্ঠ পাওয়া গেলো। নির্মম প্রহারের শিকার হচ্ছিল তার ছেলে।  লাকি যেন সেই মুহূর্তে সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে গেলেন। ফোনে ছেলের নাম ধরে চিৎকার করে মিনতি করলেন, যেন তাকে আর না মারা হয়। তাতে তো কোনো লাভ হলো না। ছেলেকে আরও বেশি নির্যাতন করা হয় কারণ তাদের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, হাতকড়া পরা সানিয়াত যখন আদালত থেকে বের হচ্ছিলেন, তার মা পেছন থেকে ছুটে যান তার দিকে। মাকে দেখে সানিয়াত হাতকড়া পরা হাত দিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন, আর মা বারবার তাকে আশ্বস্ত করেন, ‘ভয় পাস না, কিছু হবে না।’ ভিডিওটি অনলাইনে ভাইরাল হওয়ার পর পুরো পুলিশ বিভাগ সানিয়াতের ওপর আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

সেদিন মধ্যরাতের কথা। সানিয়াতের মাকে নিয়ে তার বাবা তখন হাসপাতালে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসাটিতে শুধু সানিয়াত আর তার ছোট ভাই। তাদের বাবা বারকত উল্লাহ বুলু, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। সামিয়াতের ছোট ভাই সামির মোহাম্মদ ইরফান, ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত। হুট করে রাতের বেলা পেস্ট্রি খাওয়ার আবদার করে বসে। সানিয়াত বের হন। কেক কিনেন। কেক নিয়ে দোকান থেকে বের হতেই, ডিবি’র জ্যাকেট পরা একদল অফিসার তাকে ঘিরে ধরল। পাশেই বেশ কয়েকটি গাড়ি এবং একটি বড় হাইএস ভ্যান দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিল। দুটি স্বয়ংক্রিয় রাইফেল তাক করা তার দিকে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পাকড়াও করা হয়। বাবার রাজনৈতিক পরিচয়টিকে ব্যবহার করে তাকে আটক করা হয়। পরের দিন ছিল কারফিউ। অসুস্থ থাকায় সামিয়াতের মা অ্যাম্বুলেন্সে করেই বেরিয়ে পড়েন ছেলের খোঁজে। কিন্তু থানা কিংবা ডিবি অফিস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সংস্থাই তার ছেলের ব্যাপারে কোনো তথ্য দেয়নি। সানিয়াতকে অন্তত ৭০ জনের সঙ্গে সেলে রাখা হয়। যাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বিএনপির নেতা ও সমর্থক। পরবর্তীতে, সানিয়াতকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। চোখ বেঁধে ফেলা হয় তার।

সানিয়াত জানান, জিজ্ঞাসাবাদে তাদের মূল অভিযোগ ছিল, রামপুরা থেকে উত্তরা পর্যন্ত পুরো এলাকার সহিংস কার্যক্রম নাকি আমি আর এসএম জাহাঙ্গীর মিলে নিয়ন্ত্রণ করছিলাম। মেট্রোরেল ভাঙচুরের মাস্টারমাইন্ডও বলা হলো আমাকে। অথচ এগুলো সব মিথ্যা অভিযোগ।

সানি

প্রথম দিনের রিমান্ড ছিল তুলনামূলকভাবে সহনীয়, কিন্তু দ্বিতীয় দিন থেকে নির্যাতন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। তার শরীরের নিচের অংশ ফুলে রক্ত জমাট বাঁধে। তৃতীয় দিনে নির্যাতন আরও বেড়ে যায়। এমনকি তার নখের ওপর প্লায়ার ব্যবহার করারও চেষ্টা করা হয়েছিল। পানি খেতে অনুরোধ করলে, অফিসাররা পানি না দিয়ে বরং শাস্তি হিসেবে তাকে দুইজন লোকের সাহায্যে হাঁটতে বাধ্য করত। এরপর ফোনে থাকা রাজনৈতিক নেতাদের ছবি নিয়ে আবার জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। এক পর্যায়ে, তারা তার গোড়ালিতে লাথি মারতে শুরু করে। চতুর্থ দিনের নির্যাতন ছিল ভাইরাল হওয়া ভিডিও নিয়ে।

পঞ্চম দিনে অন্যদের সাক্ষী রেখে, তিনজন সিনিয়র নেতা এবং সানিয়াতকে লাইনে দাঁড় করিয়ে পুলিশ একে একে তাদের মারধর করতে থাকে। এরপরের দিন, সানিয়াতকে আদালতে তোলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। তার মা ভোরে আদালত প্রাঙ্গণে এসে সানিয়াতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। আদালতে নিয়ে আসার পর, সানিয়াতের বিরুদ্ধে মেট্রোরেলে ভাঙচুর এবং বিদেশি অর্থ গ্রহণের অভিযোগ আনা হয়। মেট্রোরেল ভাঙচুরের মাস্টারমাইন্ড বলা হয় তাকে। এ ছাড়াও তারেক রহমানের নির্দেশে প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন প্রকল্পে হামলার জন্য একটি ‘বিশেষ মিশন’ পরিচালনার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। আদালতের কাছে তার জন্য আরও পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়।